০৪:৫৩ পূর্বাহ্ন শুক্রবার, ২৩-মে ২০২৫

ফেনী নদীর ভাঙন কি তিন উপজেলার মানচিত্র বদলে দিচ্ছে?

প্রকাশ : ২২ মে, ২০২৫ ০৪:৪২ অপরাহ্ন

শীর্ষনিউজ, ফেনী: ফেনীতে নদী ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে এসেছে ঘরের খুব কাছে। যেকোনো সময় বিলীন হবে নদীতে। উৎকণ্ঠিত বাসিন্দারা ভাঙনের দৃশ্য দেখছেন পাড়ে বসে।

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার চর দরবেশ ইউনিয়নের উত্তর চর সাহাভিখারী গ্রামের বাঁশবাড়িয়া এলাকায় ফেনী ও নোয়াখালীর তিন উপজেলায় ছোট ফেনী নদীর ভাঙন তীব্রতর হয়েছে। এতে শত শত ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও সড়ক নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের কারণে ভূমি হারাচ্ছে তিন উপজেলা। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যকর উদ্যোগের অভাবে সংকট দিন দিন আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ছোট ফেনী নদীসহ আরও দুটি নদীর ভাঙনের মুখে পড়েছে ফেনী ও নোয়াখালীর তিনটি উপজেলা। এতে কেবল ফেনী জেলারই ১৩ কিলোমিটার অংশে তীব্র ভাঙন হচ্ছে। একইভাবে ভাঙনকবলিত হয়ে পড়েছে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাও। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে এখনো নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার পূর্ণাঙ্গ চিত্র নেই।

 

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছোট ফেনী নদীর ভাঙন রোধ ও সমুদ্রের লোনাপানির জোয়ার থেকে রক্ষার জন্য সোনাগাজীর কাজীরহাটে নদীর ওপর ১৯৬১ সালে একটি রেগুলেটর নির্মাণ করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের রক্ষণাবেক্ষণ ও সঠিক তদারকির অভাবে নির্মাণের ৪১ বছর পর ২০০২ সালে রেগুলেটরটি নদীগর্ভে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ২০০৬ সালে ৮ মার্চ ছোট ফেনী নদীতে কাজীরহাট রেগুলেটরের ২০ কিলোমিটার ভাটিতে মুছাপুর রেগুলেটর নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রায় ৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১০ সালে রেগুলেটরটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। নির্মাণের ১৪ বছরের মাথায় ২০২৪ সালের ১৭ আগস্টের ভয়াবহ বন্যায় মুছাপুর রেগুলেটর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ফলে নদীর দুই পাড়েই এখন তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সোনাগাজী উপজেলার চরদরবেশ ইউনিয়নের উত্তর চরদরবেশ, উত্তর-পশ্চিম চরদরবেশ, চরসাহাভিকারী, চরইঞ্জিমান, তালতলী, তেল্লারঘাট, ফকিরাপুল, ইতালি মার্কেট এলাকা, চর মজলিশপুর ইউনিয়নের বদরপুর, মিয়াজীর ঘাট গ্রাম, বগাদানা ইউনিয়নের জেলেপাড়া, কুঠিরহাট কাটাখিলা, কালীমন্দির, আউরারখিল, আদর্শগ্রাম, কাজীরহাট স্লুইসগেট, আলমপুর, ধনীপাড়া, সাহেবের ঘাট। দাগনভূঞা উপজেলার ভাষাশহীদ সালাম নগর গ্রাম, নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর গ্রাম, মাচ্চাঘোনা, পূর্ব চরহাজারী ও চরপার্বতী ইউনিয়নের পূর্ব চরপার্বতী গ্রামের নদী উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ব্যাপক ভাঙন দেখা গেছে। ইতিমধ্যে কয়েকশ পাঁকা ও আধা পাঁকা বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

নদীর তীব্র ভাঙনে মানুষজন ভিটেমাটি হারিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। ছোট ফেনী নদীর জোয়ারের পানির তোড়ে কাজীরহাট থেকে বাংলাবাজার পাকা সড়কের প্রায় ৫০০ মিটার নদীতে বিলীন হয়ে যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ফলে বাজারের উত্তরাংশে বসবাস করা মানুষজন একমাত্র রাস্তাটি হারিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। যাতায়াতে বিঘ্ন ঘটায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সোনাগাজী ও পার্শ্ববর্তী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কৃষিনির্ভর ব্যবসায়ীরা। ভাঙন অব্যাহত থাকায় মানচিত্রে ছোট হয়ে আসছে তিনটি উপজেলা।

চরদরবেশ ইউনিয়নের উত্তর চরসাহাভিকারী গ্রামের বাঁশবাজার এলাকায় ভাঙনের শিকার বাসিন্দারা আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন। এলাকার চল্লিশোর্ধ্ব নারী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, তীব্র ভাঙনে তাঁর ঘরের কিছু অংশ নদীতে চলে গেছে। তাঁর মতো এই এলাকার ৩৫ থেকে ৪০ পরিবার নদীভাঙনে বসতভিটা হারিয়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়েছে। ভাঙন এভাবে অব্যাহত থাকলে কম সময়ের মধ্যে তাঁর ঘরের বাকি অংশও নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। মানুষের বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা জান্নাতুল কোথায় আশ্রয় নেবেন, সেই চিন্তায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।

একই এলাকার অসহায় পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী হালিমা খাতুন বলেন, সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর তাঁকে উপহার দেওয়া হয়। কয়েক বছরের ব্যবধানে সেই ঘর ইতিমধ্যে নদীতে বিলীন হয়েছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে ঘরের মালামাল নিয়ে তিনি এখন অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন।

চরসাহাভিকারী গ্রামের রিকশাচালক মো. নুর নবী (৪৫), কৃষক আবু তাহের (৫৮), হালিমা খাতুন (৫০), সুজা মিয়া (৬০), আনোয়ারা বেগম (৫৫), আবদুল মান্নান (৬০), জুলহাস (৪২), দুলাল মিয়া (৫৮) নদীভাঙনের শিকার হয়ে ঘরবাড়ি হারিয়েছেন।

চর মজলিশপুর ইউনিয়নের মিয়াজীঘাট গ্রামের দিনমজুর মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, তাঁর বাড়িসংলগ্ন মিয়াজীঘাট থেকে কাজীরহাট মুছাপুর গেট পর্যন্ত সড়কটি নদীভাঙনে বিলীন হতে চলেছে। সড়কের এক মাথার ৯০ শতাংশ নদীতে বিলীন হওয়ায় সড়কসংলগ্ন তাঁর বাড়িটি যেকোনো সময় নদীতে তলিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে তাঁর প্রতিবেশীদের তিনটি বাড়ি নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সোনাগাজী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জয়নাল আবেদীন বলেন, নদীভাঙনের কারণে এলাকায় নদীতীরের অনেক মানুষ ঘরবাড়ি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ নদীতীরে গাছ ও বাঁশ দিয়ে বাঁধ তৈরি করে বসতবাড়ি রক্ষার চেষ্টা করছেন। এভাবে নদীভাঙন অব্যাহত থাকলে সড়কটিও নদীতে চলে যাবে। নদীভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড দৃশ্যমান কোনো কাজ করছে না বলেও অভিযোগ করেন।

এদিকে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় বাঁকা নদী সোজাকরণ, এলাকার মানুষের বসতবাড়ি, কৃষিজমি ভাঙন রোধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চরমজলিশপুর ইউনিয়নবাসীর পক্ষে সাতটি স্থান চিহ্নিত করে সম্প্রতি সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবর আবেদন করেছেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রবিউল হক।

সোনাগাজীর চরদরবেশ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম জানান, নদীভাঙন প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিতে স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যে নদীর পাড়ে এসে ঘুরে তথ্য নিয়ে যান। তবে কাজের কাজ কিছুই চোখে পড়ে না।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ফেনী কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আক্তার হোসেন মজুমদার এ ব্যাপারে বলেন, ছোট ফেনী নদী, ফেনী নদী এবং কালিদাস পাহালিয়া নদীর ভাঙনের মুখে পড়েছে ফেনীর চার উপজেলা। এতে ১৩ কিলোমিটার অংশে ভাঙন হচ্ছে। ছোট ফেনী নদীর ভাঙন প্রতিরোধে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বি স্ট্রং নামে একটি প্রকল্প সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস হয়েছে। ১৭১ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি কাজ অচিরেই শুরু হবে। কাজটি শেষ হলে এ অঞ্চলের মানুষ নদীভাঙনের হাত থেকে রেহাই পাবে।

তবে গত বছরের বন্যায় নদীতে বিলীন হওয়া মুছাপুর রেগুলেটর পুনর্নির্মাণের বিষয়ে এখনো কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি সরকার। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে আপাতত কোনো তথ্য নেই বলে জানান তিনি।

শীর্ষনিউজ/প্রতিনিধি/এ. সাঈদ