রবিবার, ১৮-মে ২০২৫, ০৪:০৭ পূর্বাহ্ন
  • জাতীয়
  • »
  • জাতীয় নিরাপত্তার জন্যই স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান জোরালো করার পরামর্শ

জাতীয় নিরাপত্তার জন্যই স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান জোরালো করার পরামর্শ

shershanews24.com

প্রকাশ : ১৭ মে, ২০২৫ ০৫:১০ অপরাহ্ন

শীর্ষনিউজ, ঢাকা: বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ নিয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে রাজধানীতে। শনিবার (১৭ মে) ”নীতিগত অবস্থান থেকে চর্চায় রূপান্তর: বাংলাদেশের ফিলিস্তিন নীতির পুনঃপর্যালোচনা“ শীর্ষক আলোচনার আয়োজন করে আলাপ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এতে ফিলিস্তিনের প্রতি বাংলাদেশের নীতিকে ‘আপোষযোগ্য নয়’ এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ‘কোরভ্যালু’র সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে মত দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশকে স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে আরও সক্রিয় ভূমিকার আহ্বান জানান আলোচকরা।

রাজধানীর তোপখানা রোডে বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে আয়োজিত সংলাপে উপস্থিত ছিলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহ আল ইউসুফ, ফিলিস্তিন প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবির দুলু, জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামসুদ্দীন, বাংলাদেশ ইউনিভার্সটি অব প্রফেশনালসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো আতাউর রহমান তালুকদার, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ওমর নাসিফ আবদুল্লাহ, লেখক ও গবেষক মঈনুল ইসলাম রাকীব, জাতীয় নাগরিক পাটির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আরিফুর রহমান তুহিন, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জাহিদুল ইসলাম মিয়াজী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী মোসা. মিতু মনি, আলাপের কনভেনর জাকারিয়া পলাশ প্রমুখ।

সভায় বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ ওআইসির আলকুদস কমিটির সদস্য। গোটা মুসলিম বিশ্বের সকল দেশের মধ্যে বাংলাদেশ কারও শত্রু নয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে মুখ্য ভূমিকা পালন করা উচিত।

বক্তারা স্মরণ করিয়ে দেন যে, বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের পক্ষে বরাবরই সোচ্চার অবস্থান রাখছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে এই নীতি বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও পরিচয়ের স্বার্থ-বিবেচনায়ই গুরুত্বপূর্ণ।

বিইউপির সহকারী অধ্যাপক মো. আতাউর রহমান তালুকদার বলেন, বাংলাদেশ ফিলিস্তিনকে সমর্থন করেছিল, এটা কোনো আদর্শগত বিষয় নয়। এটাও একটি বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত ছিল। ফিলিস্তিনকে সমর্থনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা উত্তর কালে মুসলিম বিশ্বের মধ্যে নিজের জাতীয় গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে এটা তখনই বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ছিল। তিনি আরও বলেন, আমরা বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে এমন একটি মুসলিম দেশ, যার আশেপাশে সবদেশ অমুলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এসব প্রতিবেশী এলাকায় ক্রমান্বয়ে ইসলামোফোবিয়া বাড়ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে তার মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।

গবেষক মঈনুল ইসলাম রাকীব বলেন, বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিকভাবে নিজেই আরেকটি ফিলিস্তিন হওয়ার মতো অবস্থানে আছে, যেখানে ভারত একটি নব্য ইসরাইলের ভূমিকায় আছে। এ কারণেই বাংলাদেশকে তার নিজের নিরাপত্তার জন্যই বৈশ্বিক পরিসরে ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান জানান দিয়ে যেতে হবে। এর মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশ তার নিজস্ব পরিচয় ও সক্ষমতা প্রকাশ করতে পারবে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. আবদুল্লাহ আল ইউসুফ বলেন, ইসরাইল এবং তার পৃষ্ঠপোষকেরা খুবই শক্তিশালী। একটি সামরিকভাবে কম শক্তিশালী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে এজন্য খুবই কৌশলী হতে হবে। আমাদের অস্ত্রের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম ও বয়ান তৈরির মাধ্যমে কাজ করে যেতে হবে। আমাদের তুলে ধরতে হবে যে, হামাস বা ফিলিস্তিনের মানুষেরা সন্ত্রাসবাদী নয়, বরং লিকুদ পারটি বা নেতানিয়াহু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী।

অতিথির বক্তব্যে ওমর নাসিফ আবদুল্লাহ বলেন, পররাষ্ট্রনীতি জাতীয় স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হলেও ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে বিবদমান সকল পক্ষের স্বার্থ মূলত আদর্শগত। এই আদর্শভিত্তিক অবস্থা আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য আয়ারল্যান্ড, ব্রাজিল, চীনসহ যেসব দেশ ইসরাইলের বিরুদ্ধে আছে, সেগুলোকে কৌশলের সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে হলে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করতে হবে।

ফিলিস্তিন প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান জিয়াউল কবির দুলু বলেন, আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমরা আশা করেছি যে, ফিলিস্তিনের জন্যও স্বাধীন দেশ অর্জন করতে হবে। তাই ১৯৮১ সালে আমি ও অনেকে যুদ্ধ করতে গিয়েছি। আমি আমৃত্যু চাইবো যাতে ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্রের অধিকার ফিরে পায়।

সভায় বক্তারা আরও বলেন, বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের নাগরিকদের অনেকে বিভিন্ন ইসরাইলি ব্যক্তির সঙ্গে গোপনে সাক্ষাত করছেন এবং অনেকে গোপনে ইসরাইল ভ্রমণ করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে কঠোর আইনি ব্যবস্থার নেওয়ার দাবি করা হয়।

লিখিত বক্তব্যে আলাপ কনভেনর জাকারিয়া পলাশ বলেন, “যেকোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য জাতীয় স্বার্থ গুরুত্বপূর্ণ। তবে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক ও ভুখণ্ডের নিরাপত্তার মধ্যেই জাতীয় স্বার্থ সীমাবদ্ধ নয়। বরং রাষ্ট্রের জাতীগত পরিচয় ও দীর্ঘমেয়াদী নীতির সুরক্ষাও রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ বলে বিবেচ্য। সেগুলোও দেশের কোর ভ্যালু যা নন-নেগোশিয়েবল। বাংলাদেশের কোর ভ্যালুর অন্যতম হচ্ছে দমন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে অবস্থান এবং যে কোনো জাতির মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে থাকা। একইভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নেওয়াও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির এমন একটি কোর ভ্যালু। এটি কোনো রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্ত নয়, এটি একটি সর্বজন সমর্থিত নৈতিক অবস্থান, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রাষ্ট্রচিন্তার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত।“

বক্তারা বলেন, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের জনগণ সর্বদা ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে ছিল, যা আমাদের জাতীয় পরিচিতির অংশ। তবে জুলাই বিপ্লবের আগে ফ্যাসিস্ট রিজিমে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিসরে ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে বাংলাদেশকে কৌশলগত নীরবতাও লক্ষণীয় ছিল। সেই সঙ্গে সুকৌশলে পাসপোর্ট থেকে ‘একসেপ্ট ইজরায়েল’ শব্দবন্ধ বাদ দিয়ে ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দিকে যাওয়ার কৌশলও আমরা লক্ষ করেছি। তাছাড়া আনঅফিসিয়াল ট্রেডের মাধ্যমে ইসরাইলি প্রযুক্তি ক্রয়ের খবরও এদেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীণ সরকার জনপ্রত্যাশার প্রতি সম্মান জানিয়ে পাসপোর্টে ‘একসেপ্ট ইজরায়েল’ শব্দবন্ধ যুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে, যা ইতিবাচক।

সভায় আলাপের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনের জনগণের পক্ষে বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থানকে আরও সক্রিয় ও তৎপর কূটনৈতিক চর্চায় রূপ দানের প্রস্তাব করা হয়। এজন্য প্রভাবশালী দেশগুলোতে বাংলাদেশের দূতাবাসের সঙ্গে ”সিম্বলিক অ্যাম্বাসেডর ফর প্যালেস্টাইন অ্যাফেয়ার্স” এটাচ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। সব আন্তর্জাতিক ইভেন্টে “নন-ভারবাল বা সিম্বলিক বার্তা” এবং নন-ট্র্যাক ডিপলোমেসির মাধ্যমে বাংলাদেশের অবস্থান পুনঃপ্রচার করার কথা বলা হয়। এছাড়া তরুণ প্রজন্মকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অবস্থান এবং তার ঐতিহাসিক যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পাঠ্যপুস্তকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আলোচনা এবং ফিলিস্তিনের প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সমর্থন অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করা হয়।–বিজ্ঞপ্তি

(শীর্ষনিউজ/ক.ম)